পরম সমাদরণীয় আশ্রমিক রবীন্দ্র স্নেহধন্য সন্তোষকুমার মজুমদারের উত্তরসূরি সুমনা সেনের অতীব সংবেদনশীল শান্তিনিকেতনের বর্তমান সমস্যা সংক্রান্ত একটি লেখা এবং আরও কিছু মানুষের কিছু লেখা থেকে বেশি করে জানতে পারা যায়, কত মানুষের কত রকমের নীরব দানে গড়ে উঠেছে আবহমান ভারতবর্ষের আত্মা-রূপ শান্তিনিকেতন।
আজকের শান্তিনিকেতনকে রক্ষা করতে অনেক নতুন জিনিসের আমদানি করার দরকার হবে, একথা বোঝা দুর্বোধ্য নয়। পাঁচিল শান্তিনিকেতনের পক্ষে কিছু নতুন জিনিস না হলেও তারও প্রয়োজন স্বীকার করে নিতে হবে। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস যখন 'প্রয়োজনীয়' হয়ে ওঠে, দরকার হয় অতীব সংবেদনশীলতার সঙ্গেই তাতে হাত দেওয়ার। জানতে হবে, শান্তিনিকেতন মানে শুধু একটা ভৌগোলিক অবস্থান-মাত্র নয়, একটা আত্মিক অবস্থানও। যার অত্যুজ্জ্বল আধার শান্তিনিকেতনে বসবাসকারী বা শান্তিনিকেতনের মনের মাটি দিয়ে তৈরি দিকে দিগন্তরে থাকা মানুষেরা। এই সব মানুষের নিরন্তর শুভেচ্ছা ও সহযোগিতা শান্তিনিকেতনের চিরন্তন সম্পদ --- কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল থেকে পাওয়া সম্পদই শুধু নয়। তাই এই সমাদরণীয় আশ্রমিকদের বিমুখতা নয়, উন্মুখতাকে আকর্ষণ করে রাখা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্য কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
বিশ্বভারতীর আসন্ন শতবর্ষ নিয়ে যথোপযুক্ত প্রস্তুতি লক্ষ করছি না তেমন। কলকাতায় বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকীর সূচনা হয়েছিল নিবেদিত কিছু মানুষের নিজস্ব উৎসাহে --- প্রায় তিন বছর আগে থেকেই। শুরু হয়েছিল সপ্তাহে সপ্তাহে বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত আলোচনা। নতুন নতুন পুস্তক প্রকাশের প্রস্তুতিও তার সঙ্গে দেখা যায়। আশা করি দেরিতে হলেও মানব ইতিহাসের অনুপম সৃষ্টি এই বিশ্বভারতীর শতবর্ষের যথাসাধ্য আয়োজন অচিরেই হতে থাকবে।
বিশ্বভারতীর শতবর্ষে এক দুর্লভ সুযোগ তার কাছে উপস্থিত হয়েছে । এক অভূতপূর্ব আত্মবিস্তারের মধ্যে দিয়ে তার নিজেকেই চিনবার। রামগড়ে শতাধিক বছর ধরে প্রতীক্ষিত দ্বিতীয় শাখার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। বিশ্বভারতীর তরফ থেকে এখনো পর্যন্ত বিশেষ কোনো প্রয়াস ছাড়াই যদিও। তা হলেও, বিশ্বভারতী তবুও পালন করতে পারে এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক ভূমিকা। ভারতের স্বাধীনতা-প্রাপ্তির ঘটনা থেকেও গৌরবে যা এতটুকু ন্যূন নয়। কারণ, কবি ওই 'পার্লামেন্টিক' প্রকরণের পথে স্বাধীনতা অর্জনকে 'স্বাধীনতার উল্টো পথ' বলে মনে করতেন। শিক্ষাসংস্কার ও পল্লীসঞ্জীবনের কাজকেই মনে করতেন স্বাধীনতা প্রাপ্তির 'সোজা পথ' বলে। শান্তিনিকেতনের আজ সুযোগ এসেছে আত্ম-সম্প্রসারিত হওয়ার । শান্তিনিকেতনের সঙ্গে জুড়ে আছে শ্রীনিকেতন নামের তার যে অন্য ডানাটি, কবি যাকে একদা আসল বলে জানতে বলেছিলেন, তাকে শুধু অগ্রাধিকার দিয়ে রামগড়ে সম্প্রসারিত করা নয়, ভারতবর্ষের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই তাকে জুড়ে দেবার চেষ্টা করার। যার দ্বারা এক একটি ব্লককে অন্তত বেকারত্ব মুক্ত করার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে তারা সকলে। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের কাছে শিখে নিতে পারে তার সমাজ-অধ্যাত্ম প্রযুক্তি। তার আগে বোলপুর-শ্রীনিকেতন ও রামগড় ব্লকে নিজেরা তা করে দেখানোর ব্যবস্থা করে। এর জন্য দরকার ছাত্র শিক্ষক আশ্রমিক রবীন্দ্রপ্রেমী --- সকলের সানন্দ এবং সর্বান্তর সহযোগিতা আকর্ষণ করা। তাঁদের সকলের মাঝেমধ্যে 'আঙুলকে ডাকা নয়, আত্মাকে ডাকা' (এই কথাগুলি কবি গান্ধীজির চরকা-আশ্রিত আন্দোলনের প্রতিতুলনায় বিবেকানন্দের সার্বিক আহ্বানকে স্মরণ করে বলেছিলেন)। এ সম্পর্কে আমাদের চিন্তায় প্রাথমিকভাবে যেটা আসে তার রেখাচিত্র অন্য অবকাশে তুলে ধরা যেতে পারে।
কিন্তু --- এখানে অবশ্যই একটা কিন্তু আছে। সকলের সহযোগিতা আকর্ষণ করতে গেলে সভ্যতার প্রলম্বিত ইতিহাসে শান্তিনিকেতনের সুদূর দিগন্তস্পর্শী সম্ভাবনার বৃহৎ পটচিত্রটির দিকে একবার তাকিয়ে তারপর দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ করা চাই চোখ। এবং তার কিছু পরে চোখ খুলে খোঁজা চাই পথ। দেখা যাবে, সে পথে কণ্টকের পাশে পাশেই, কখনো কখনো পরপারে --- কুসুমের সমূহ বিস্তার। যে পথের ধারে পক্ষে-প্রতিপক্ষের ভেদরেখা হয়ে গেছে ক্রমশ অস্পষ্ট। অপেক্ষাকৃত অবলীলায় আমরা পৌঁছে যেতে পারছি আমাদের গন্তব্যে। যদি আমরা একটু থমকে থেমে যথার্থভাবে নিজেদের প্রস্তুত করে নিতে পারি --- সংকল্পে এবং সমর্পণে। বিষণ্ণ বসুন্ধরা আমাদের এই শান্তিনিকেতনের কাছেই আজ এই মিনতিই বুঝি জানায়।
সেই জন্যে, শান্তিনিকেতনের অদ্যতনী, প্রাক্তনী সকলের হাতে এসে যাক আজ ছোট ছোট কাজ। শুধু শান্তিনিকেতনের মধ্যে নয়। 'ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর' করার কাজ। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অনুষঙ্গকে ক্রমশ জুড়ে দেবার কাজ। কারণ, শান্তিনিকেতন শুধু বিশ্বভারতীর মধ্যে মুখ গুঁজে মরবার জন্যে তৈরি হয় নি। রামগড়েও সুখাসীন বা সুখান্তরীণ হবার জন্যে নয়। সমগ্র ভারতবর্ষ তথা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়াই তার স্বাভাবিক ভবিতব্য। নদীর ভবিতব্য যেমন সাগরে পৌঁছানো।
আপনাকে আজ বাইরে মেলবার এই শুভলগ্নে তথাকথিত সব পক্ষের শান্তিনিকেতন সত্যিই কি পারে না সকলে মিলে কাজ শুরু করতে --- হাতে হাতে ধরি ধরি ? ক্ষতি যত ক্ষত যত, নিমেষের সেই 'কুশাঙ্কুর'-গুলিকে সমূলে এবং সবেগে সমুৎপাটিত করতে করতে ?
যদ্ভদ্রং তন্ন আসুব !
Comments